শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১

ছোট উদ্যোগে সফল নারীরা, বাড়িতে তৈরি পণ্য যাচ্ছে বিদেশে

উদ্যোক্তা মানে এক প্রকার যোদ্ধা, সাহসী যোদ্ধা। সাহসী না হলে উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে অর্থায়নের প্রয়োজন, প্রয়োজন পরিবারের সম্মতি। যদি হয় নারী উদ্যোক্তা, তাহলে তো তার জন্য আরও বাধা। পদে পদে বাধা। তবে সব বাধা পেরিয়ে এখন সফল রাজধানীর উত্তরা এলাকার কয়েকজন নারী। যাদের অনেকেই শিক্ষার্থী, কেউ কেউ গৃহিণী। কেউ আবার চাকরি ছেড়ে বেছে নিয়েছেন ব্যবসাকে, হয়েছেন সফলও।

সফল এসব নারী উদ্যোক্তার নেই কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কল-কারখানা। বাড়িতেই তৈরি করেন পণ্য। যার মধ্যে রয়েছে- খাদ্য সামগ্রী, শাড়ি, থ্রি-পিস, গজ কাপড়, ক্যালিগ্রাফি, কসমেটিকসসহ আরও অনেক কিছু। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এসব পণ্য এখন যাচ্ছে বিদেশে। এই ব্যবসার আয় থেকে এসব নারী পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে সঞ্চয় করছেন, বাড়িয়েছেন ব্যবসার পরিধি। এ নারী উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যবসার গল্প একে-অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে মিলিত হন ‘লেডিস কেয়ার বিউটি আড্ডা (এলসিবিএ)’ নামের ফেসবুক গ্রুপে। এখানে পণ্যের মান, নতুন নতুন উদ্যোগ শেয়ার করেন একে-অন্যের সঙ্গে।

এমন নারী উদ্যোক্তাদের একজন আফতাবুর নাহার। শোনালেন তার সফলতার গল্প। সম্প্রতি আফতাবুর নাহার বলেন, ‘একসময় খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে জামদানি শাড়ি দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। ক্রেতার আস্থা অর্জনই প্রথম দিকে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে মানসম্পন্ন পণ্য ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা ছিল। পরবর্তী সময়ে ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিধিও। এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পণ্য যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা। আমার পুরো ব্যবসাটাই অনলাইন ভিত্তিক। সব পণ্যই জামদানির তৈরি। রয়েছে জুতা, ব্যাগ, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিসহ শাড়ি। গায়ে হলুদের প্যাকেজও রয়েছে আমাদের কালেকশনে।’

নারী হওয়ার কারণে পরিবারের অনেকেই ব্যবসা শুরুর দিকে বাধা দিয়েছে। এখন সফলতার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের আস্থাও অর্জন করতে পেরেছি। পরিবারের সদস্যরাই এখন আমার ব্যবসার সহযোগী।

তিনি বলেন, ‘আমার পণ্য অনলাইনে বিক্রি করি। দেশের ৬৪ জেলাতেই পণ্য পাঠিয়ে দেই। যারা আমার পণ্য কিনেছেন তারাই অন্যদের কিনতে উৎসাহিত করেছেন। এভাবে বিক্রি বেড়েছে। প্রতিমাসে এখন আয় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য রয়েছে আমাদের। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমার পণ্যের ক্রেতা। তারা পণ্যের অর্ডার করেন অনলাইনে (ফেসবুক পেজ এস কে ফ্যাশন), কুরিয়ারের মাধ্যমে তাদের ঠিকানায় পণ্য পাঠিয়ে দেই। এই ব্যবসা আমাকে সফলতা এনে দিয়েছে, স্বামীসহ পরিবারের অন্যরা আমার ব্যবসায় সহযোগী হয়েছেন।’

শখের বশে ক্যালিগ্রাফি করেন নাহার লিজের স্বামী। এই ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমেই উদ্যোক্তা হয়েছেন লিজ। স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে সংসারে এনেছেন স্বচ্ছলতা। স্বামীর তৈরি ক্যালিগ্রাফি অনলাইনে বিক্রি করেন নাহার লিজ।

নাহার লিজ বলেন, ‘স্বামী চাকরি করেন। চাকরির টাকায় সঞ্চয় করা যায় না, সংসার খরচেই চলে যায় সব। চাকরির পাশাপাশি শখের বসে নিজ হাতে ক্যালিগ্রাফি তৈরি করেন আমার স্বামী। এছাড়া ফুলদানিসহ এখন প্রায় ৬০ প্রকার পণ্য তৈরি করি আমরা। নিজেদের তৈরি আর ঘরে বসেই সেগুলো অনলাইনে বিক্রি করি। এতে পারিবারে বাড়তি টাকার সংস্থান হয়েছে। এখন কিছু সঞ্চয়ও করতে পারছি।’

বুটিকস নিয়ে প্রায় ৬ বছর ধরে কাজ করছেন সুবর্ণ সোমা। তার তৈরি পণ্য বিক্রিও হচ্ছে বেশ। ‘লেডিস কেয়ার বিউটি আড্ডা (এলসিবিএ)’ নামের ফেসবুক গ্রুপে বিক্রি করেন তার তৈরি পোশাক। এছাড়া রয়েছে ইন্ডিয়ান থ্রি-পিস, পাকিস্তানি পোশাক। অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে খুলেছেন শোরুম। টাকার জন্য এখন আর তাকে পরিবারের ভরসায় থাকতে হয় না, বরং পরিবারকেই আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারছেন।

ছোট উদ্যোগে সফল নারীরা, বাড়িতে তৈরি পণ্য যাচ্ছে বিদেশে নারী উদ্যোক্তা আফতাবুর নাহার, আনিকা মরিয়ম, আর কে ফাহমিদা

‘লেডিস কেয়ার বিউটি আড্ডা (এলসিবিএ)’ গ্রুপ থেকে উৎসাহ পেয়ে আনিকা মরিয়ম এখন নিজেই ব্যবসায়ী। এখনো তার শিক্ষাজীবন শেষ না হলেও পরিবারকে দিতে পারছেন আর্থিক সাপোর্ট। মেয়েদের কসমেটিক্স আইটেম নিয়ে কাজ করছেন আনিকা। সঙ্গে রয়েছে জুয়েলারি আইটেম। এগুলো বিক্রি করছেন অনলাইনে। লেডিস কেয়ার বিউটি আড্ডা গ্রুপের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব পেজ অরেঞ্জ হোম শপের মাধ্যমে সারাদেশে পণ্য বিক্রি করছেন। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে তার পণ্য। মূলত চীন বা অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্য এনে সেগুলো বিক্রি করছেন। একাজে সহায়তা করছেন তার মা। মা-মেয়ের সাহসী এই উদ্যোগে প্রতিমাসে পরিবারে যোগ হচ্ছে অর্ধ লক্ষাধিক টাকার বাড়তি আয়।

‘রাজকন্যা কালেকশন’ পেজের মাধ্যমে অনলাইনে নিজের পণ্য বিক্রি করছেন মরিয়ম আক্তার নামের আরেক উদ্যোক্তা। মূলত হাতে রঙ করা (হ্যান্ড পেইন্ট) পোশাক বিক্রি করেন মরিয়ম। এছাড়া তৈরি করেন জুয়েলারি আইটেমও। তার তৈরি এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেশে ও দেশের বাইরে। মরিয়ম এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও তার স্বপ্ন আরও বড়। সরকার বা ব্যাংকের মাধ্যমে সহজে ঋণ পেলে নিজের ব্যবসাকে আরও বড় করতে পারতেন বলে জানান তিনি।

এক সময় ১০ হাজার টাকার জন্য পরিবারের দিকে চেয়ে বসে থাকতো হতো। এখন পরিবারের খরচ বহনের পাশাপাশি বাড়তি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা মাসে সঞ্চয় হচ্ছে। এখন পরিবার যেমন আমার প্রতি খুশি, আমিও পরিবারকে সাপোর্ট দিতে পেরে খুশি।

নারীদের কাছে এখন বেশ পরিচিত আর কে ফাহমিদা। দেশি গজ কাপড়, সুতি কাপড়ের ব্যবসা তার। রয়েছে নকশিকাঁথার ব্যবসাও। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন তার পণ্য যাচ্ছে দেশের বাইরে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা তার পণ্যের মূল ক্রেতা।

ফাহমিদা বলেন, ‘নারী হওয়ার কারণে পরিবারের অনেকেই ব্যবসা শুরুর দিকে বাধা দিয়েছে। এখন সফলতার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের আস্থাও অর্জন করতে পেরেছি। পরিবারের সদস্যরাই এখন আমার ব্যবসার সহযোগী। আগামীতে ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ানোর ইচ্ছে আছে।’

খাদ্যসামগ্রী নিয়ে কাজ করছেন শিল্পী খান। মূলত পিঠা-পুলি তার মূল পণ্য। দেশের বিভিন্ন এলাকার ঐতিহ্যবাহী পিঠা জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনছেন তিনি। ঘরে বসে নিজে তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করছেন এসব পিঠা। ‘শিল্পী কিচেন’ নামের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এগুলো বিক্রি করছেন। পিঠার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে দুপুরের খাবার। উত্তরা এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার খাবারের আইটেম। অনলাইনে প্রতিদিন শত শত ক্রেতার অর্ডার পাচ্ছেন। সবসময় চেষ্টা করেন নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতার কাছে টাটকা খাবার পৌঁছে দিতে। অর্ডার বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতার চাহিদা মেটাতে এখন বেশ হিমশিম খেতে হয় তাকে।

শিল্পী খান বলেন, ‘এক সময় ১০ হাজার টাকার জন্য পরিবারের দিকে চেয়ে বসে থাকতো হতো। এখন পরিবারের খরচ বহনের পাশাপাশি বাড়তি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা মাসে সঞ্চয় হচ্ছে। এখন পরিবার যেমন আমার প্রতি খুশি, আমিও পরিবারকে সাপোর্ট দিতে পেরে খুশি।’

সংগ্রামী জীবন থেকে সফলতার দেখা পেয়েছেন রেশমা আক্তার মিতু। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় নিয়েছিলেন আইএলও প্রশিক্ষণ। ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে উদ্যোক্তা হবেন। কিন্তু বাবার ব্যবসায় ধস নামায় শিক্ষাজীবন থেকেই ছোট পরিসরে শুরু করেন ব্যবসা। এখন সেই ছোট ব্যবসাকে এনেছেন বেশ বড় পরিসরে। দেশের বাইরে থেকে কসমেটিকস আইটেম এনে অনলাইনে বিক্রি করছেন। নিজের পেজ ‘সিল্ক গ্লামার’ থেকে অর্ডার নিয়ে দেশের ৬৪ জেলায় পৌঁছে দিচ্ছেন কসমেটিকস। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে খেজুরের গুড়, সরিষার তেলসহ আরও কিছু অর্গানিক পণ্য। নিজের এলাকা চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ থেকে এগুলো সংগ্রহ করেন মিতু। সবমিলিয়ে এখন তার মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকার ব্যবসা।

রেশমা আক্তার মিতু বলেন, ‘ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা (ঋণ) পেলে আগামীতে আরও বড় পরিসরে ব্যবসা করার ইচ্ছে আছে।’

Join Manab Kallyan