মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ২৮ মাঘ, ১৪৩১

সম্পদ মূল্যবান কিন্তু জীবন অমূল্য

প্রভাষ আমিন

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই একটি অভিশপ্ত মাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আন্দোলন, বিক্ষোভ, হত্যা, নির্মমতা, নৃশংসতা, নাশকতা, ধ্বংসযজ্ঞ, গুজব- একসাথে সবকিছুর এক নিষ্ঠুর প্রদর্শনী দেখেছে বাংলাদেশে। ১৬ থেকে ২০ জুলাই এই পাঁচদিন বাংলাদেশ ছিল সংঘাতময়। বিশেষ করে ১৮ ও ১৯ জুলাই সবকিছু ছিল অন্ধকারে; বাংলাদেশ ছিল অরক্ষিত, অসহায়, নিরাপত্তহীন। কেউ পুরোপুরি জানতো না দেশে আসলে কী হচ্ছে।

এই সময়টা আসলেই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা অন্ধকার সময়। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়ে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ছাত্রদের বিরুদ্ধে সেনা মোতায়েন করতে চাননি। তাই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে ঘরে ফেরার পরই সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে।

এখনও দেশে সেনা মোতায়েন আছে, নিয়মিত বিরতিতে চলছে কারফিউও। তবে এবারের সেনা মোতায়েন ও কারফিউ আগের মতো নয়। সাধারণভাবে কারফিউ চলছে কিছুটা শিথিল আকারেই। কারফিউর সময় সেনাবাহিনী রাস্তায় টহল দেয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু সেনাবাহিনী কারো সাথেই কঠোর আচরণ করেননি। সেনাবাহিনী মূলত বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্যই মাঠে নেমেছে। সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষ কারফিউ ও সেনা মোতায়েনকে স্বাগত জানিয়েছে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে।

পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর এখন বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র, এ যেন ধ্বংসম্তূপ। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার্থীদের হাত থেকে চলে যায়। তারপর থেকে শনিবার পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তালিকা করে করে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের লক্ষ্য ছিল ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। সে কারণে ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোকে টার্গেট করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপনযাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরা, মোহাম্মদপুরে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। বেছে বেছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ধ্বংস করা হয়েছে। সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ডেটা সেন্টার, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, কারাগার- তালিকা ছিল বাছাই করা, আক্রমণ হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। ঘটনার সময় আসলে কী ঘটছে, তা জানা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। কারণ ঘটনাস্থল এতটাই বিপজ্জনক ছিল, সাংবাদিকদের পক্ষেও সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যারা গেছেন তারা হামলার শিকার হয়েছেন, সাংবাদিকদের প্রাণ গেছে, অনেকে আহত হয়েছেন, অনেক সম্পদ নষ্ট হয়েছে। তাই উত্তরা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ীতে আসলে কী হয়েছে তা পুরোপুরি জানা যায়নি, হয়তো কখনো পুরোটা জানা যাবেও না।

বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক টানা পাঁচদিন বন্ধ ছিল। ইন্টারনেটসহ সবধরনের শিল্প-কারখানা, গার্মেন্টস, উৎপাদন, বন্দর, আন্তর্জাতিক লেনদেন, বাণিজ্য বন্ধ থাকায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। মোট ক্ষতির পরিমাণ কত, তা এখনও নিরূপণ করা যায়নি, হয়তো পুরোপুরি করা যাবেও না। এক খবরে দেখলাম মোট ক্ষতির পরিমাণ বলা হচ্ছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। তারচেয়ে বড় কথা হলো, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা আর্থিক মানদণ্ডে পরিমাপ করাও সম্ভব নয়, পূরণ করাও সম্ভব নয়।

আর্থিক যে ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে, তা কমবেশি পূরণ করা যাবে। টাকা থাকলে আরো অনেক মেট্রোরেল আমরা বানাতে পারবো। কিন্তু মানুষের প্রাণের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কখনোই পূরণ করা যাবে না। সমস্যা হলো আমরা আর্থিক ক্ষতি নিয়ে যত কথা বলছি, মানুষের জীবন নিয়ে তত কথা বলছি না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার যে ভয়ঙ্কর সংবাদ আসছে, তা দেখে, শুনে, পড়ে আসলে আমি নিজে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।

বিপুলসংখ্যক মৃত্যুতে শুধু আমি নই, গোটা জাতি শোকে স্তব্ধ। পাশাপাশি আরেকটা বিষয় আমার ভাবনার জগৎকেই বদলে দিয়েছে। এত মৃত্যু যেমন আমরা আগে দেখিনি, এমন নির্মমতাও নজিরবিহীন। পুলিশ যেমন খুব কাছ থেকে গুলি করে মানুষ মেরেছে। আবার পুলিশকে মেরে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। এই বাংলাদেশের মানুষের মনে এতটা নৃশংসতা লুকিয়ে ছিল, এটা আমার ভাবনার জগৎকেই এলোমেলো করে দিয়েছে।

যত খবর জানছি, ট্রমা ততই বাড়ছে। শুধু আমি নই, গোটা জাতিই এক ধরনের ট্রমায় আক্রান্ত। কবে, কীভাবে এই ট্রমা কাটবে আমরা জানি না। সমস্যা হলো, অন্য সব ঘটনার মতো এ ঘটনায়ও আমরা বিভক্ত হয়ে আছি। একপক্ষ পুলিশের নিষ্ঠুরতার ছবি ও খবর দিচ্ছে। বাবার কোলে থাকা শিশু হত্যা, কাছ থেকে গুলি করে মানুষ হত্যার নিষ্ঠুরতা নেওয়া যায় না। আবার আরেক পক্ষ দিচ্ছে পুলিশকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের দেহরক্ষী জুয়েল মোল্লাকে মেরে উলঙ্গ করে উল্টো করে লটকে রেখে লাশের নিচে উল্লাস, র্যাবের ড্রাইভারকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার খবর দিচ্ছে। কিন্তু নিষ্ঠুরতাকে এভাবে পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ করাটাও এক ধরনের নিষ্ঠুরতা। মানবতাই একটা পক্ষ। এর কোনো বিপক্ষ নেই, থাকতে পারে না। সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিষ্ঠুরতার ছবি এতই ভয়াবহ, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া, সহ্য করা কঠিন। ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডে পড়বে বলে অনেক ছবি প্রকাশ্যে আসছে না। তবে বিভিন্ন গ্রুপে এসব ছবি চালাচালি হচ্ছে। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করলেও নিষ্ঠুরতার এমন ব্যাপকতা আমি দেখিনি আগে। মানসিক সুস্থতার জন্য সব ছবি আমি দেখিওনি। আমি না দেখলেও ঘটনা তো আর মিথ্যা হয়ে যাবে না। বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দুইশরও বেশি মানুষ মারা গেছে এ কদিনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক অতিরঞ্জন আছে। কিন্তু দুইশর বেশি মানুষের মৃত্যুও সারাদেশকে শোকস্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে দিয়ে মৃত্যুর মিছিল শুরু, তার শেষটা কোথায়, কীভাবে আমরা পুরোটা জানি না। মৃত্যুর মিছিলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আছে, ছাত্রলীগ আছে, শিশু আছে, সাধারণ মানুষ আছে, আক্রমণ করতে আসা দুষ্কৃতকারী আছে, পুলিশ আছে, র্যাব আছে।

কে, কোথায়, কবে, কখন, কীভাবে, কার হাতে, কোন অস্ত্রে মারা গেছে জানি না। জানি আর না জানি বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু তো আর মিথ্যা নয়। মৃত্যু কারো কারো কাছে নিছক সংখ্যা। কিন্তু যে পিতার সন্তান মারা গেছে, যে শিশুর পিতা মারা গেছে; তার কাছে এই শোক আজীবনের, দুর্বহ। প্রত্যেকটি পরিবারকে এই শোক বয়ে বেড়াতে হবে।

বিপুলসংখ্যক মৃত্যুতে শুধু আমি নই, গোটা জাতি শোকে স্তব্ধ। পাশাপাশি আরেকটা বিষয় আমার ভাবনার জগৎকেই বদলে দিয়েছে। এত মৃত্যু যেমন আমরা আগে দেখিনি, এমন নির্মমতাও নজিরবিহীন। পুলিশ যেমন খুব কাছ থেকে গুলি করে মানুষ মেরেছে। আবার পুলিশকে মেরে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। এই বাংলাদেশের মানুষের মনে এতটা নৃশংসতা লুকিয়ে ছিল, এটা আমার ভাবনার জগৎকেই এলোমেলো করে দিয়েছে।

পৃথিবীতে সবকিছু টাকা দিয়ে কেনা যায়। মানুষের জীবন ছাড়া। বিজ্ঞান অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। কিন্তু বিজ্ঞান এখনও মানুষের জীবন দিতে পারে না। তাই সবকিছু টাকা দিয়ে কেনা গেলেও মানুষের জীব অমূল্য। আর্থিক ক্ষতি কত হয়েছে জানি না। যতই হোক, কোনো না কোনো একদিন তা পূরণ হবে। কিন্তু যে মানুষগুলো মারা গেলো, তারা কখনো ফিরে আসবে না।

আগেই যেমনটি বলেছি, এখানে কোনো পক্ষ নেই। মানবতাই একমাত্র পক্ষ। আন্দোলনকারী না পুলিশ, এভাবে আলাদা করার সুযোগ নেই। প্রত্যেকটা মৃত্যুর তদন্ত করতে হবে। দায়ীদের শাস্তি দিতে হবে। এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়েছে। কিন্তু তাদের এখতিয়ার শুধু ১৬ জুলাই সহিংসতায় নিহত ছয়জনের মৃত্যুর কারণ তদন্ত। দাবি জানাচ্ছি, এই কমিশনের এখতিয়ার বাড়িয়ে পুরো ঘটনার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করা। তবে এটা করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।

নির্মমতার যে ভয়ঙ্কর চিত্র আমরা দেখেছি, তার কোনো ক্ষমা নেই। যে দলেরই হোক, যে মতেরই হোক, আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা না করেই সবার বিচার করতে হবে। মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি আমি করছি না। মৃত্যুর ক্ষতির কোনো পূরণ হয় না। আমি বিচার চাই, প্রত্যেকটি হত্যার বিচার চাই।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

Join Manab Kallyan