শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪, ২৪ কার্তিক, ১৪৩১

স্মরণ: গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী

মার্জিয়া লিপি , লেখক, গবেষক

একাত্তরের অগ্নিগর্ভ মার্চ। বনেদি ঘরের ছেলে ফতেহ আলী চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র । বাবা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান আমলের জেলা জজ।  অভিজাত হালফ্যাশনের জামা-কাপড়, চোখে ব্যান্ড লাগানো চশমা পরে মাঝে মাঝে বাবার সরকারি গাড়িতে ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া ছিল তার নৈমিত্তিক রুটিন। সমাজ-সংসার-দেশ-রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক মানুষ ছিলেন তিনি। আড্ডা, গল্প, খেলাধুলা আর ঘুরে ফিরেই দিন কাটছিল। বাস্কেট বল আর ক্রিকেট ভালো খেলতেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের বিপ্লবের মতবাদ শুনে শুনে মার্ক্সবাদী থিউরি বুঝতে জেদ করেছিলেন ফতেহ। যেখানে যা পেয়েছেন সব পড়েছেন এক নিমিষে।  সবসময় পকেটে রাখতেন কমিউনিজমের হটকেক- মাও সে তুংয়ের ‘দ্য রেডবুক’।  রেভলিউশনের মায়াজালে বুঁদ হয়ে থাকা ফতেহ চৌধুরী তখনো কল্পনাও করতে পারেনি কি ভয়ংকর এক বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি। ২২ বছর বয়সী ফতেহর চারপাশে ঘিরে থাকা বিচিত্র সেই জগতের ঠিক বাইরেই তখন চলছিল বিপ্লব।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সে বিপ্লবে অন্যমাত্রা যোগ হয়। বিপ্লব মোড় নিতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে। ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় শুনতে পেয়েছিলেন, রাতে ক্র্যাক ডাউন হবে। তখনও বুঝতে পারেনি এর ভয়াবহতা। মর্টার শেলিং আর মেশিনগানের বিকট শব্দে ঘুম থেকে জেগে বসে থাকেন। বাইরের আকাশ তখন ট্রেসার বুলেটের ফুলকিতে আলোকিত। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে আর্তনাদ আর আর্তচিৎকারে। পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম এক আঁধার রাত ছিল সেটা- যে অমানিশার গালভরা নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট।

পরদিন সকালে বাইরে বেরিয়েছেন ফতেহ। হঠাৎ চোখ পড়ে এক ভিসতিওয়ালার ওপর, (ভিসতিওয়ালা – যারা ফেরি করে পানি সরবরাহ করতেন) । বাড়ির সামনে মরে পড়ে আছে। সকালে বোধহয় পানি দিতে বেরিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার গুলির শিকার। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় ভিসতিওয়ালার বুক। এভাবে বিনা কারণে মরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি। ভেতরে জন্ম হয় এক ধরনের ক্রোধ। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উল্লেখযোগ্য পটভূমি ছিল নিরপরাধ ভিসতিওয়ালার গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মৃতদেহটি।

১৯৭১ সাল । ডা. জাফরুরুল্লাহ্ চৌধুরী, সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফের বিশেষ একটি অ্যাসাইমেন্টে ঢাকায় আসেন। ফতেহ আলী চৌধুরীর এক বন্ধু বকুল, ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকায় আসেন। বকুলকে ফতেহ বলেন, ‘‘মায়ের  (জাহানারা বেগম) সঙ্গে দেখা করে বকুল যেন বলেন, ‘ফতেহ ভালো আছে। খাবারের কোনো কষ্ট হচ্ছে না। আর্মিদের খাবার-দাবার অনেক ভালো। প্রতিদিন দুধ, ডিম, মাখন দিয়ে পরোটা খেতে হয়, তা না হলে যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু বকুল, জাহানারা বেগমকে মিথ্যা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। প্রশ্ন করেন জাহানারা বেগম, ‘কাপড় কে ধুয়ে দেয়’? তখন বকুল বলেন, ‘কি যে বলেন, খালাম্মা, নিজেদের কাপড় ধুতে হয়। শুইতে হয় খড়ের গাঁদায়।’’

অথচ সে সময়ে ফতেহ আলী চৌধুরীদের বাড়িতে ছিলো স্প্রিংয়ের খাট। কথা শেষে বকুল, মা -জাহানারা বেগমকে সান্ত্বনা  দিয়ে বলেন, ‘‘খালাম্মা আমরা তো যুদ্ধ করতে গেছি, পিকনিকে না। আমরা তো খাওয়া-দাওয়া চাই না, আমরা চাই অস্ত্র, আমরা চাই বুলেট।’’ মা বকুলকে আরও জিজ্ঞেস করেন, ‘‘ফতেহ কি যুদ্ধ করতে পারে?’’ বকুল মায়ের প্রশ্নে বলেন, কি বলেন খালাম্মা, ‘‘ফতেহ তো আমাদের আই সি – টু; সেকেন্ড ইন কমান্ড। ফতের অনেক বুদ্ধি।’’

jagonews24

অ্যাসাইমেন্ট শেষে ঢাকা থেকে আগরতলায় ফিরে আসার পর বকুলের কথা শুনে ফতেহ আলী চৌধুরীর মনে হয়, ‘‘মা- জাহানারা বেগম হয়তো বকুলের কথা শুনে সন্তানের গর্বে একটু অহংকারী হয়ে উঠেছিলেন। তাই হয়তো তিনি বলেছিলেন, ‘‘যুদ্ধে তো গেছ, যুদ্ধ তো করতেই হবে, ফেরা তো আর যাবে না।’’

ফতেহ আলী চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ২নং সেক্টরের অধীন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ৩৪ জন সদস্যের একজন ছিলেন তিনি। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম এবং এটিএম হায়দার, বীর উত্তম  ঢাকায় অপারেশনের জন্য ক্র্যাক প্লাটুনের জন্ম। কর্নেল হায়দারের মতো অসাধারণ ট্রেনারের ছোঁয়া পেয়ে জ্বলে উঠেছি দাবানলের মতো। ঢাকার স্থানীয় ছেলেদের সদস্য করা হয়, যারা ঢাকার অলিগলি খুব ভালোভাবে চেনেন। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য অন্তর্ভুক্তের শর্ত ছিল- কথাবার্তা, ট্রেনিং ইত্যাদিতে চৌকস হতে হবে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে । যাতে বিপদ বুঝে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকলে যেন আত্মগোপন করতে পারে। ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক সদস্যই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলের অথবা বুয়েটের ছাত্র- যারা ঢাকা শহরকে নিজের হাতের তালুর মতো চিনতেন।

সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ শহরের গেরিলাদের বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরে যেটুকু সম্ভব অপারেশন চালাতে যাতে পাকবাহিনী কিছুটা হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়।’ ঢাকা শহরের সব চাইতে সুরক্ষিত জায়গা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের  (বর্তমান হোটেল শেরাটন) সামনে বোমা ফেলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মিশন অবস্থান করছিলেন সেসময়ে শেরাটনে। এ ঘটনার পর মিশন রিপোর্টে করেন,  ‘পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়- যেটা “স্বাভাবিক” দেখাতে পাক সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। ’ এই সংবাদ শুনে মেজর খালেদ মোশাররফ চোখ কপালে তুলে বলেন- “মাই গড, দিজ আর অল ক্র্যাক পিপল!” সেই থেকে এই দলটির নাম হয় ক্র্যাক প্লাটুন।

 

‘ফতেহ’ নামটির অর্থই বিজয়ী। ‘‘মা জাহানারা বেগম বলতেন, ‘যুদ্ধে গিয়েছ; তাই ফেরার তো পথ নেই- জয়ী হয়েই ফিরতে হবে।’’ বিজয়ী আমৃত্যু যোদ্ধা- ফতেহ আলী চৌধুরী ১৭ ফেব্রুয়ারি অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। নিঃসন্দেহে এদেশের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে  তার সংগ্রামী অধ্যায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

ফতেহ আলী চৌধুরী  ক্র্যাক প্লাটুন নিয়ে বলেছিলেন, ‘মেজর খালেদ মোশাররফ এমন একটি দল চেয়েছিলেন যেটি কোনো ব্যক্তির নামে হবে না, এটা হবে একেবারে হাত দিয়ে বাছাই করা সদস্যদের একটি স্পেশালাইজড বা ক্র্যাক টিম (আরবান ডিকশনারি অনুযায়ী ক্র্যাক শব্দটির একটি অর্থ অতিমাত্রায় বিশেষায়িত )।’ মূলত এ ধারণা থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন নামটির উৎপত্তি। মুক্তিবাহিনীর মাত্র ১৭ জন গেরিলাই কাঁপিয়ে দেয় পুরো ঢাকা শহর। বিশেষ করে জুলাইজুড়ে চালানো বেশ কয়েকটি ভয়ংকর অপারেশনের এক পর্যায়ে আতঙ্কে সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি সেনাদের নিয়মিত টহল  বন্ধ হয়ে যায়।

একাত্তরের ২৯ আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শুরু হয় এক যন্ত্রণাময় করুণ অধ্যায়। গেরিলা বাহিনী  মে মাস থেকে যেসব গোপন আস্তানা প্রতিষ্ঠা করেন সেগুলোতে হানাদার বাহিনী চড়াও হয়। ঢাকার প্রায় সব বাড়িঘরে অভিযান চালায়। আলবদরের কর্মীদের তথ্য মতো বেলা ১১টায় বদিউল আলম (বীর বিক্রম) ধরা পড়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিনের বাসা থেকে।  বিকালে ধরা পড়েন আব্দুস সামাদ। অকল্পনীয় টর্চারের মুখে সহযোদ্ধাদের ঠিকানা বলে দিতে বাধ্য হন। ৩৪ জনের মধ্যে ধরা পড়েন ১৫ জন। জুয়েল (বীর বিক্রম শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল), রুমী (বীর বিক্রম শহীদ শাফী ইমাম রুমী) ও তার বাবা, আজাদ (বীর প্রতীক মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ) ও তার দুই ভাই, বাকি এবং মুক্তিযোদ্ধা আলভীসহ (আবুল বারক আলভী) তাদের অনেক আত্মীয়স্বজনকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায়।

ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সংবাদের ভিত্তিতে, ফতেহ আলী চৌধুরী বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন এলিফ্যান্ট রোড, জাহানারা ইমামের বাসা খুঁজতে । কিন্তু বহু খুঁজেও প্রিয় সহযোদ্ধা রুমির বাসাটা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। সেদিনই রাত ২টায় ধানমন্ডির কনিকা থেকে জামি, রুমি, শরীফ ইমামসহ- পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। একই সময়ে রেইড হয় শাহাদাৎ চৌধুরী ও ফতেহ আলী চৌধুরীদের হাটখোলার বাসায়।  তাদের না পেয়ে সেনারা  তাদের বড় বোনের স্বামী বেলায়েত হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়।

জাহানারা বেগম ও আবদুল হক চৌধুরী তিনজন মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত পিতামাতা। মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত চৌধুরী, ফতেহ আলী চৌধুরী ও ডা. মোরশেদ চৌধুরী। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র- হাটখোলায় ছিল তাদের বসবাস।  তিরিশের গোড়ার দিক থেকে হাটখোলার পুরোনো ধাঁচের এ বাড়িটির একটি নিজস্ব ইতিহাস ছিল । পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে  হাটখোলার এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে অনেকেই ভাষা সংগ্রামে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের উনিশ বছর পর আবারো এই বাড়িটিতেই রহস্যজনকভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে!  ৩০ নম্বর হাটখোলা রোডের বাড়িটি যুদ্ধের সময় পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন একটি আশ্রয় কেন্দ্রে।

অস্ত্র ও গোলা-বারুদের ভান্ডার হিসেবে বাড়িটি ব্যবহার করা হতো।  যুদ্ধকালীন ঢাকায় তৎপর বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপের সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে ছিল এ বাড়িটি । মুক্তিবাহিনীর জন্য উন্মুক্ত ছিল ।  যুদ্ধের সময় সবার প্রিয় আর আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। কালক্রমে সে পরিবারের তিন মেয়ে আধুনিক মানসিকতার- মরিয়ম, ডানা, ঝিমলীও- মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধের অংশ  হয়ে যান। তারা পরিণত হন মুক্তিযোদ্ধাদের বোনে। সব শংকা আর উৎকণ্ঠার মাঝেও সে বাড়িতে সবার আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করা হতো।

এপ্রিলের শুরুর  দিকে বাসা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যান। বলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। মা’র জন্যে একটি চিঠি লিখে আবুল বারাক আলভীকে বলেন, ‘‘চিঠিটা বাড়ির সামনে হাটখোলা লেটার বক্সে ফেলে দিতে।’’ মা’র জন্যে লেখা চিঠিতে ফতেহ আলী চৌধুরী লেখেন, ‘‘মা যুদ্ধে চললাম। স্বাধীন দেশে ফিরবো।’’ চিঠি পড়ে মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।’’ দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ হবে। সন্তান যুদ্ধের মতো অনিশ্চিত পথে যাত্রা করবে তা ছিল তাদের কল্পনারও অতীত। অথচ সময়ের প্রয়োজনে সেই মা ই পরিণত হয়েছিলেন আশ্রয় আর ভরসার কেন্দ্রবিন্দু।

 

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীর মাধ্যমেই ফতেহ আলী চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয় আমার ।  ২০১৬ এর ২৬ অক্টোবর গুলশান অফিসে বসে তিনি বলেছিলেন – ‘ফতেহ’ নামটির অর্থই বিজয়ী। ‘‘মা জাহানারা বেগম বলতেন, ‘যুদ্ধে গিয়েছ; তাই ফেরার তো পথ নেই- জয়ী হয়েই ফিরতে হবে।’’ বিজয়ী আমৃত্যু যোদ্ধা- ফতেহ আলী চৌধুরী ১৭ ফেব্রুয়ারি অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। নিঃসন্দেহে এদেশের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে  তার সংগ্রামী অধ্যায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: গবেষক ও পরিবেশবিদ।

Join Manab Kallyan