জন্মদিন, জন্মদিনের কেক ও জন্মদিনের গান, হোক নিজের কিংবা কাছের মানুষের, আমরা উদযাপন করতে ভালোবাসি, উপভোগ করতে ভালোবাসি, অনুভব করতে ভালোবাসি, আমরা স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসি।
আচ্ছা, পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার দিনটাও যে প্রাণবন্ত উদযাপনের উপলক্ষ হতে পারে এই ধারণার জন্মই বা কবে? জন্মদিন উপলক্ষে প্রচলিত রীতি, গীতির উৎপত্তি বা কোথা থেকে? জন্মদিন মানেই জন্মদিনের কেক ও জন্মদিনের মোমবাতি। এটা কি অতি আধুনিক রীতি নাকি এর পেছনেও আছে অতীত ইতিহাস কিংবা কোনো রূপকথা, অন্ধবিশ্বাস? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের মনেই উঁকি দেয়। তবে জানেন না এর আদ্যোপান্ত। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক জন্মদিনের জন্মক্ষণ ও ইতিহাস।
প্রাচীন মিশরীয়দের থেকে সর্বপ্রথম কেকের ধারণা পাওয়া যায়। তখনকার কেক কিন্তু মোটেই এখনকার কেকগুলোর মতো ছিল না। শুকনো ফলের বীচি, শুকিয়ে রাখা ফলমূল এবং তখনকার দিনের প্রচলিত ওয়াইনের সংমিশ্রণে তৈরি হত সেগুলো। তবে ইউরোপে জন্মদিনে কেকের প্রচলন নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতে, প্রথম জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটার প্রচলন শুরু হয় গ্রিক বা রোমানদের থেকে। আবার অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন জন্মদিনে কেকের প্রচলনটা শুরু করেন জার্মানরাই।
সে যাই হোক, মধ্যযুগে জার্মানরাই সর্বপ্রথম লেয়ার্ড কেকের উদ্ভাবন করেন। ইতিহাস বলে, যিশুখ্রীষ্টের জন্মদিনকে কেন্দ্র করেই মূলত জার্মানদের কেক কাটার শুরু। গবেষকগণের মতানুসারে তাই ধরে নেওয়া যায় আসল জন্মদিনের যে কেক, সেটার শুরু হয় জার্মানি থেকেই।
প্রাচীনকালে রোমান ও গ্রিকদের মধ্যে জন্মদিনসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল কেক। তারা যে কোনো উৎসব ’প্লাকাস’ নামে গোলাকৃতির সমতল এক প্রকার কেক বানাতো। তখনকার দিনে যেহেতু গ্রিসে এবং রোমে ময়দা, মধু, ফলমূল এবং বিভিন্ন প্রকারের বাদাম ছিল খুব সহজলভ্য, তাই কেকের মূল উপাদানও ছিল সেগুলোই। তবে গ্রিকরা ’স্যাটূরা’ নামে আরও এক ধরনের কেক বানাতো। সেটি চন্দ্রদেবী আর্তেমিসের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত প্রার্থনা অনুষ্ঠানের জন্য। চন্দ্রদেবীকে উৎসর্গ করে তৈরি এই স্যাটূরা কেক ছিল চাঁদের মতোই গোল আকৃতির।
কেকের মধ্যে প্রথম ফিউশন প্রথাটা রোমানদের থেকেই আসে। তারাই প্রথম ময়দা, ফলমূল, বাদাম এবং মধুর বাইরে এসে কেকে যুক্ত করেন চিজ বা পনির। যা থেকে বিবর্তিত হতে হতে আজকে আমাদের চিজকেক। রোমানদের জন্মদিন গ্রিকদের মতো ছিল না। তারা তিনভাবে জন্ম উৎসব পালন করত। নিজেদের আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জন্মদিন পালন করতেন রোমানরা। আবার জীবিত বা মৃত প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজা-মহারাজাদের জন্মদিন ঘটা করে উদযাপন করার রীতি ছিল। এমনকি রোমানদের ভেতরে কারো বয়স ৫০ হলে সেটাও উদযাপন করার প্রথা ছিল সবাই মিলে।
জন্মদিনকে কেন্দ্র করে কেক কাটার প্রচলনের ইতিহাসে ব্রিটিশরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। তারা কেকের ভেতরে ছোট কয়েন বা উপহার রেখে দিতেন। বার্থডে বয় বা গার্ল যখন কেক কাটতো, চমকপ্রদভাবে সেই কয়েন বা উপহার বের হয়ে জন্মদিনের খুশিকে দ্বিগুণ করে তুলতো। শুধু কি তাই? ব্রিটিশরা মনে করতেন এই কয়েন বা ছোট উপহারটি জন্মদিনে আশীর্বাদ বয়ে আনে।
মজার বিষয় হলো শিল্পায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের সেই সময় থেকেই আরও অন্যান্য বিষয়ের মতো পশ্চিমাদের এই কেক কাটার সংস্কৃতিও বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে কেকের রেওয়াজ কিন্তু ব্রিটিশদের হাত ধরেই। ব্রিটিশদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আগে এ উপমহাদেশে জন্মদিন পালন করা হতো বিভিন্ন প্রচলিত মিষ্টান্ন, ক্ষীর বা পায়েশ দিয়ে। তবে এখনো অনেকে কেকের সঙ্গে এসব মিষ্টান্নও যুক্ত করেন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে।
এবার আসি জন্মদিনে মোমবাতি নেভানোর প্রথায়। ওই যে বলেছিলাম, গ্রিক চন্দ্রদেবী আর্তেমিসের আরাধনায় গ্রিকরা গোল আকৃতির কেক বানাতো। চন্দ্রদেবীকে তুষ্ট করতে গ্রিকরা কেকের চারিপাশ চাঁদের দ্যুতির মতো আলোকজ্জ্বল রাখতেন মোমবাতিতে আগুন জ্বালিয়ে। প্রতি চন্দ্র মাসের ষষ্ঠ দিনে তারা আর্তেমিসের মন্দিরে এভাবে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতেন। গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন যে মোমবাতিতে ফুঁ দিলে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, সেই ধোঁয়াই দেবীর কাছে তাদের আকাঙ্খা, অভিপ্রায় বহন করে নিয়ে যায়।
মতান্তরে শোনা যায়, কেকের সঙ্গে মোমবাতি জ্বালানোর নিয়মটি আসে ১৮৮১ সালে সুইজারল্যান্ডের মধ্যবিত্তদের মধ্যে থেকে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, সুইজারল্যান্ডের মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি ছিলো কুসংস্কার জর্জরিত। তারা বিশ্বাস করতেন জন্মদিনে মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নেভালে মনের ইচ্ছাগুলো পূরণ হয়ে যায়। এজন্য ব্যক্তির বয়স অনুসারে, ঠিক ততটি মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম ছিল সুইজারল্যান্ডের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে।
তবে অনেকে এ-ও মনে করেন যে, প্রধানত প্যাগানরা মোমবাতি জ্বালানোর সংস্কৃতির উদ্ভাবক। প্যাগানরা মোমবাতিকে তাদের শক্তির প্রতীক ধরতেন। তারা ভাবতেন, যার জন্মদিন তার আশপাশে সেই দিনটিতে অসংখ্য অশুভ আত্মারা ঘোরাফেরা করে, যারা তাদের ক্ষতি করতে চায়। এজন্য প্যাগানদের মধ্যে রীতি ছিল, যার জন্মদিন তাকে আত্মীয় স্বজন সবার মধ্যে ঘিরে রাখা এবং মোমবাতি জ্বালানো। তাদের বিশ্বাস ছিল অশুভ আর দুষ্ট আত্মাগুলো মোমবাতির আগুনকে ভয় পায়।
এবার আসা যাক জন্মদিনের গানের কথায়। ১৮৯৩ সালে স্কুল শিক্ষিকা দুই বোন প্যাটি হিল এবং মিলড্রেড হিল বাচ্চাদের মর্নিং উইসের জন্য একটা গান বানালেন। গানটির কথাগুলো ছিল এরকম- ‘গুড মর্নিং টু ইউ/ গুড মর্নিং টু ইউ/ গুড মর্নিং, ডেয়ার চিল্ড্রেন/ গুড মর্নিং টু অল’। সুর ঠিক রেখে শুধু কথাগুলোতে ভিন্নতা এনে যা এখন প্রচলিত- ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ/ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ/ হ্যাপি বার্থডে ডেয়ার (নাম)/ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’।
প্যাটি হিল এবং মিল্ড্রেড হিল কি জানতেন তাদের রচিত সেই গানের অনুপ্রেরণায় তৈরি হবে এমন একটি গান যা একদিন পেয়ে যাবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বাধিক গাওয়া ইংরেজি গানের তকমা? অথবা অনূদিত হবে বিশ্বের ১৮টির মতো ভাষায়? কে জানতো স্কুলের শিশুদের জন্য বাঁধা মর্নিং উইসের এই গানকে কেন্দ্র করে একদিন রচিত হবে জন্মদিনের গান, উৎসবের প্রতিকৃতি! কে-ই বা জানতো এই সুরটি ছাড়া জন্মদিনের উৎসব পূর্ণতাই পাবে না!
লাইফস্টাইল মডেল: আফিয়া রোজা