ক্ষমতার সমবণ্টন কথাটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনো সেভাবে কেউ ভাবেনি। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক— সব ক্ষেত্রেই কথাটা সমান সত্যি। ক্ষমতার দলবদল হয় বটে, কিন্তু শাসকদের জাতিগত ও শ্রেণিগত চরিত্র বা চেহারার আমূল পরিবর্তন হয় না।
তাই একটা পর্যায়ে গিয়ে জনগণের সাথে যে বিশাল ফারাক সৃষ্টি হয় শাসকরা তা ক্ষমতায় থাকতে বুঝতে পারেন না। ক্ষমতার রাজনীতি আসলে স্থিতাবস্থাটুকু বজায় রেখে চলে, তা সেই রাজনীতি আর যে রঙেরই হোক না কেন।
এই স্থিতাবস্থার রাজনীতি আজকের নয়। অনাদিকাল থেকেই চলে আসছে। ক্ষমতার প্রতি আসক্তির মূলেই রয়েছে নিয়ন্ত্রণপ্রীতি। জনতা স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠলে তড়িঘড়ি করে নিয়ন্ত্রণ আরোপ ছাড়া উপায় থাকে না। শাসকের হাতের কাছে থাকে যে চক্রটি তারা তাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করে, সুবিধা নেয়, পদ নেয়, পদবি নেয় কিন্তু যুক্তিযুক্ত সদুপোদেশ দেয় না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে রাজনৈতিক চর্চার চাইতে বেশি চলে অর্থের চর্চা। শাসক দলকে যারা এই ইন্ধন প্রদান করে সেই পুঁজিবাদী ও প্রভাবশালী জাতি এবং শ্রেণি যারা শাসকের অসময়কালে চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের একমাত্র লক্ষ্য হলো সুযোগ, সুবিধা ও ক্ষমতার একতরফা কেন্দ্রীকরণ। এদের মধ্যে সাংবাদিক আছে, শিক্ষক আছে, লেখক কবি আছে, আছে আমলা এবং অতি অবশ্যই লুটেরা ব্যবসায়ী আছে।
শাসক শ্রেণি ও তাদের সমর্থনকারীদের মধ্যে চলে পারস্পরিক সুবিধার আদানপ্রদান। বিগত ৫৩ বছরে এই অর্থনৈতিক সুবিধার প্রশ্নে যখন রাষ্ট্র, রাষ্ট্র-নেতা, শাসক-দল ও ধর্মের মধ্যে বিভাজন বিলীন হয়ে গেছে, তখন সেই স্থিতাবস্থা আরও ঘনীভূত হয়েছে। স্থিতাবস্থার সমালোচনা মাত্রই তা হয়ে গেছে ঘোর রাষ্ট্রবিরোধিতা, এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদ।
এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন আমাদের সামনে যে বাস্তবতা উপস্থিত করেছে সেটা অগ্রাহ্য করার একটা মানসিকতা বড়ভাবে উপস্থিত হয়েছে আমাদের সামনে। রাজনীতি কত নিখুঁত ভাবে নাগরিক জীবন পঙ্গু বানিয়ে দেয় তার নজির আমরা দেখলাম।
মানুষ যদি সব কিছু বিনা যুক্তিতে মেনে নেয়, তা হলে সে তো ক্রীতদাস। কিন্তু মানুষ যদি অবুঝের মতো সবকিছুতে গা ভাসিয়ে দেয় তাহলে সে যে আরও বড় ক্রীতদাস সেই বুঝটাই নাগরিক সমাজে তৈরি হয়নি। বিরোধিতা না থাকলে সমাজে দ্বন্দ্ব আসবে না, প্রগতি হবে না। কিন্তু বিরোধিতা নিজেই যখন প্রগতির পথ রুদ্ধ করে তখন?
দেশ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। গঠনগত উন্নতি কিছুই হচ্ছে না। অর্থনৈতিক জিডিপি নিয়ে বেশি ভাবতে গিয়ে সাংস্কৃতিক জিডিপি ভাবনার সময়ই আসেনি। ফলে রাজনীতির পরিবর্তনের ডাক এলেও আসে না মানুষের বিবেক ফেরানোর ডাক।
দুর্নীতিগ্ৰস্ত ও দুর্নীতিবাজদের সংখ্যাধিক্য এবং প্রভাবশালীদের নৈকট্য অর্জন করাই এখন আদর্শ। দুর্নীতিগ্ৰস্তরা একদিকে যেমন স্থানীয় প্রশাসন ও নেতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, আবার দুর্নীতির অর্থের কিছুটা অংশ জনস্বার্থে দান করেও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থাটা বদলানোর প্রয়োজন।
শাসকের চাপিয়ে-দেওয়া রাজনীতির চক্করে পড়ে মানুষ যেমন সব কিছুই সয়ে চলে নীরবে, তেমনি শাসকবিরোধী চক্রের চক্করে পড়ে মানুষ চলে আফগানিস্তানের মতো অন্ধকারের পথে। মানুষও তাই বুঝে গেছে, মেনে নেওয়া আর মানিয়ে চলাই এখন তাদের জীবনযাপনের পথ।
দেশের সব সাধারণ মানুষের অসুবিধা, দুর্ভোগ নিয়ে কেউ ভাবিত নন। একদিকে গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র, অন্যদিকে তার বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্মীয় বিভাজনের খেলা। একদিকে উন্নয়ন, উল্টো পিঠে দুর্নীতির কালাপাহাড়; একদিকে নির্মম সাম্প্রদায়িক খেলা তো আরেক দিকে নাগরিকের ওপর অত্যাচার।
শাসকের বিরুদ্ধে কথা বললে, রোষানলে পড়তে হয়। কিন্তু যুক্তিগ্রাহ্য কথা বললে এর চাইতে বড় শাস্তির খাঁড়া নেমে আসতে পারে বিপক্ষ গ্রুপ থেকে। সেই ভয়ে মেনে নেওয়া, সয়ে চলাই শ্রেয় মনে করেন অনেকে। এক অদ্ভুত অসংবেদনশীল মনোবৃত্তি আমাদের তিলে তিলে গ্ৰাস করে ফেলছে।
এ থেকে মুক্তির উপায় কী এখন সেটাই ভাবনা হওয়া দরকার। প্রথম কথা হলো মতাদর্শ ও দেনাপাওনা নিয়ে দ্বন্দ্ব হওয়া বা অসন্তোষ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কের সুবাদে নিবিড় দেনাপাওনানির্ভর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যাকে বলা হয় পেট্রন-ক্লায়েন্ট রিলেশন। এটা গত ১৫ বছরে অতিমাত্রায় হয়েছে।
এই পুরো সময়টাতে দেওয়া-নেওয়ার রাজনীতিই প্রাধান্য পেয়েছে। হাসপাতাল থেকে কবরস্থান, শাসক দলের আনুগত্য থাকলে সর্বত্রই বাড়তি সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। মানুষ একদিকে দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে মরেছে, অন্যদিকে সরকারি কর্মী আর শাসক দলের লোকজনের পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি দেখে দেখে একটা আগুনের অপেক্ষায় ছিল।
গত ১৫ বছরে মানুষকে-হেনস্তার ঘটনাগুলো শাসকের ভাবমূর্তিকে বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। তার প্রমাণ বেশি করে পাওয়া যায় শিক্ষাঙ্গনে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। রাজনীতিবিদরা এমন একটি সিস্টেম বানিয়েছেন যে, এই রাজনীতির খপ্পরে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভয়াবহ অনৈতিক, অন্যায় কাজে, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন প্রবল ভাবে সমাজের সর্বত্র বিরাজ করে সন্ত্রাসের পরিবেশ। সেটা পরে শাসককেই খেয়ে ফেলতে চায়।
দুর্নীতিগ্ৰস্ত ও দুর্নীতিবাজদের সংখ্যাধিক্য এবং প্রভাবশালীদের নৈকট্য অর্জন করাই এখন আদর্শ। দুর্নীতিগ্ৰস্তরা একদিকে যেমন স্থানীয় প্রশাসন ও নেতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, আবার দুর্নীতির অর্থের কিছুটা অংশ জনস্বার্থে দান করেও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থাটা বদলানোর প্রয়োজন।
শান্তি ফিরে এলে সেই ভাবনাটা আসুক। ব্যক্তি বা সমষ্টি সবার ক্ষেত্রেই একটা আদর্শগত অবস্থান শক্তপোক্ত না হলে অনিয়মের শিকার হয় পুরো সমাজ।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল।