মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকাসহ আরও কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কয়েকদিনের টানা ভারী বৃষ্টিতে নোয়াখালি, ফেনি, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। খাগড়াছড়ি বান্দরবানে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। সাজেক ও লংগদুর সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ফেনীতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে অনন্ত ২৫টি গ্রাম। এ ছাড়া প্রবল বৃষ্টিতে বিভিন্ন জেলায় পানিবদ্ধতার কারণে মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ফেনীর উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরামে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নয়টি অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে লোকালয়ে পানি ঢুকে অন্তত ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো মানুষ। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নদীর পানি বিপৎসীমার ২৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাত ১২টার দিকে উপজেলার পশ্চিম অলকার মাস্টারবাড়ি সংলগ্ন মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। রাত ১০টার দিকে মির্জানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ কাউতলি কাশিনগর ও চম্পকনগর এলাকায় বাঁধের দুইটি অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এদিন বেলা ১১টার দিকে উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শালধর জহির চেয়ারম্যানের বাড়ি সংলগ্ন মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। পরে দক্ষিণ শালধর এলাকায় বাঁধের আরও একটি অংশে ভাঙনের দেখা দিয়েছে। এতে মালিপাথর, দক্ষিণ শালধর, নিলক্ষ্মী এবং পাগলিরকুল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত মাসেও বাঁধের একই স্থানে স্থানে ভাঙনের দেখা দিয়েছিল।
চাঁদপুর সংবাদদাতা জানান, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গত বুধবার দুপুর থেকেই চাঁদপুরে শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। এরপর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত জেলায় বৃষ্টি হয়েছে ১০৭ মিলিমিটার। টানা বৃষ্টিপাতে মসজিদ ও বাসা বাড়িতেও পানি উঠে গেছে। এদিকে টানা দুইদিনের ভারী বৃষ্টির কারণে চাঁদপুর শহরের বেশ কয়েকটি সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে আবাসিক এলাকার সড়কগুলোর অবস্থা বেহাল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অসচেতনতার কারণে ড্রেনের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। শহরের নাজির পাড়া, মাদরাসা রোড, পালপাড়া, নিউ ট্রাক রোড, রহমতপুর আবাসিক এলাকায় টানা বৃষ্টিপাতে সড়কে পানি জমে আছে। বৃষ্টি কমলে পানি কিছুটা হ্রাস পায়। আবার বৃষ্টি হলে একই অবস্থা।
লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা জানান, টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীর জোয়ারের পানিতে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছে জেলা কৃষি বিভাগ। জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘনা তীরবর্তী এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি খুব সহজে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এতে নদীভাঙনসহ উপকূলীয় বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
পটুয়াখালী সংবাদদাতা জানান, একটানা প্রবল বর্ষণে পটুয়াখালীর জনজীবন অচল হয়ে পড়েছে। গত বুধবার মধ্যরাত ১টা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে তা গতকাল বৃহস্পতিবার সারাদিন চলার ফলে পটুয়াখালী জেলার জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। শহরের অধিকাংশ রাস্তা ঘাটসহ লোকালয়ের মধ্যে বৃষ্টি পানি প্রবেশ করে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় সকলকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ দিকে পটুয়াখালীর আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মো. রাহাত হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা থেকে আজ শুক্রবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত অতিভারি মাত্রার ১৯২.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।এ ছাড়াও জেলার বাউফল,দুমকী, মির্জাগঞ্জ সহ উপকূলীয় এলাকা কলাপাড়া,রাঙ্গাবালী ,গলাচিপা এলাকায় প্রবল বর্ষনের কারনে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। এদিকে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। পটুয়াখালীর পায়রাসহ সব সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সকল মাছধরা ট্রলার সমূহকে নিরাপদ থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি সংবাদদাতা জানান, অতি ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে মাইনি ও চেঙ্গী নদীতে পানি বাড়ায় সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে জেলার মেরুং ও কবাখালি ইউনিয়ন ও জেলার সদরের ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন অংশ ডুবে যাওয়ায় লংগদু ও সাজেক পর্যটন কেন্দ্রের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
পাহাড়ি ঢলে দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেড কোয়াটার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবে গেছে মেরুং বাজার।
দীঘিনালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ধর্মজ্যোতি চাকমা বলেন, পাহাড়ি ঢলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়ন ও কবাখালি ইউনিয়নে ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণের কারণে মাইনী নদীর পানি বেড়ে বন্যর সৃষ্টি হয়েছে। সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করছি।
বান্দরবান সংবাদদাতা জানান, টানা দুই দিনের ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় লামা-আলীকদম সড়কের তিনটি স্থান ডুবে গেছে। ফলে লামার সঙ্গে আলীকদমের এবং আলীকদমের সঙ্গে লামা ও চকরিয়া যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টি এখনো অব্যাহত থাকায় মাতামুহুরী নদীর পানি আরও বাড়তে পারে। এদিকে বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কেও পাহাড়ধস ও নিচু এলাকার সড়ক ডুবে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সকালে নীলগিরি এলাকায় পাহাড়ধসে কিছুক্ষণের জন্য যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছিল। বলীপাড়া বাজার এলাকায় একটি সেতু ডুবে গেছে।
ঝালকাঠি সংবাদদাতা জানান, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে। টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে জেলা শহরে বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিতে শহরের বিভিন্ন সড়কে হাঁটু সমান পানি জমেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন শহরবাসী। সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দুই দিনের বৃষ্টির কারণে শহরের কয়েকটি প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১৫টি সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। যান চলাচলেও সমস্যায় পড়ছেন চালকরা। বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়িতে পানি প্রবেশ করছে। দোকানপাট খুলছে না ব্যবসায়ীরা। একদিকে সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে জোয়ার, অন্যদিকে টানা বৃষ্টি পানিতে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বিপর্যস্ত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পরেছে সাধারণ মানুষ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, মৎস্যজীবীসহ সাধারণ মানুষ। কৃষকারা জানান, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে রোপা আমন ও আমনের বাজীতলাসহ লতাকৃষি নিমজ্জিত রয়েছে। বৃষ্টির পানি স্থায়ী হলে আমন বীজতলার ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
চট্টগ্রামের মীরসরাই সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাইয়ের সোনাপাহাড় এলাকায় চট্টগ্রামমুখী লেইনে পানি উঠেছে। সড়কে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে ওই মহাসড়কে চলাচলরত যাত্রী সাধারণ। স্থানীয় বাসিন্ধারা জানায় পাহাড়ি ঢল আর ভারি বষর্ণের কারণে সড়কটি ডুবে গেছে। সড়কে পানি জমায় সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজট। জানা গেছে, মীরসরাইয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনাপাহাড় এলাকার আরশিনগর ফিউচার পার্ক ও বিএসআরএম শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে জোরারগঞ্জ রাস্তার মাথা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। সড়ক ডুবে যাওয়া চলাচলরত যানবাহণগুলো চলছে ধীর গতিতে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট। যানজট সৃষ্টি হওয়ায় দূর্ভোগে পড়েছে ওই সড়কে চলাচলরত যাত্রীরা।
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, হটাৎ করে পদ্মার পানি কমে যাওয়ায় স্রোতের তোড়ে পদ্মা নদীতে ভাঙন তীব্র হয়েছে। এতে ফরিদপুর জেলা সদরের প্রায় তিন শতাধিক বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া সদর থানার ডিক্রিচড় ও নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের চারটি গ্রামের রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, ক্লিনিক ও ৩ কোটি টাকার সরকারি গোলাডাঙ্গী ব্রিজটি এখন হুমকির মুখে পড়ছে। ভাঙ্গন এভাবে অব্যাহত থাকে ফরিদপুর জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়েছে যাবে সম্পুর্ন একটি ওয়ার্ড।নদী ভাঙনে গত ছয়দিনে ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ইউসুফ মাতুব্বরের ডাঙ্গীর প্রায় ৭০-৮০টি বাড়ি ভেঙে পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে কমপক্ষে দেড়শো পরিবার চরম মানবেতর জীবন-যাপন করছে।