বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৬ ফাল্গুন, ১৪৩১

কোটা সংস্কার আন্দোলন

গুলিতে নিহত কুড়িগ্রামের ৩ ব্যক্তির পরিবারে হাহাকার

ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে কুড়িগ্রামের তিন যুবক নিহত হয়েছেন। আন্দোলনে সংঘর্ষের সময় গুলিতে প্রাণ হারান তারা। নিহত তিনজনের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তারা কেউ আন্দোলনের সাথে বা কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তারা পরিস্থিতিতে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন।

নিহতরা হলেন- জেলার উলিপুর উপজেলার ব্যাংক কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম (৩৫), কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার রাজমিস্ত্রী নুর ইসলাম (২২) এবং নাগেশ্বরী উপজেলার রাজমিস্ত্রী গোলাম রব্বানী (২০)।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পৌর শহরের মুন্সিপাড়ার আব্দুর রশিদের একমাত্র সন্তান রায়হানুল ইসলাম। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে একেবারে বাকরুদ্ধ। নিহত রায়হানুলের স্ত্রী রিতু আক্তার ৪ মাস বয়সী কন্যা রাওযান মনিকে নিয়ে একেবারেই অসহায় পড়েছেন।

শেষবার জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বাড়িতে এসেছিলেন রায়হানুল। সেসময় স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, ঢাকার বাড্ডা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন তিনি। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিবার নিয়ে সেখানে উঠবেন। সেই কথা আর রাখতে পারলেন না রায়হানুল। রায়হানুলের সাথে সেটাই শেষ দেখা হবে তা ভাবতে পারছেন না পরিবারের কেউ। বাড়ির সবাই কাঁদছে, অথচ কান্নার কোনো কারণ বুঝতে পারছে না রাওযান মনি। চার মাসের এই ছোট্ট বাচ্চার স্মৃতিতে বাবার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না! ছোট্ট পরির মতো মেয়েকে নিয়ে চোখে আঁধার দেখছেন রিতু। কী হবে তাদের আগামী জীবন! রাষ্ট্রের কাছে এই হত্যার বিচার চান তিনি। চান ক্ষতিপূরণ।

রায়হানুলের বাবা আব্দুর রশিদ জানান, রায়হানুল ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে চাকরি হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেখানে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতো।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে পাওয়া তথ্যানুযায়ী তিনি জানান, গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বাড্ডা এলাকায় জুম্মার নামাজ শেষে বাসায় ফিরছিল রায়হানুল। সেসময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী আর পুলিশের সংঘর্ষে মাঝে পড়ে যায় সে। সেসময় তার ডান চোখের পাশে গুলি লেগে পিছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। পরদিন শনিবার সকালে উলিপুরে পৌঁছে রায়হানুলের লাশ। সকাল সাড়ে ১১টায় এমএস স্কুল এ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে উলিপুর কেন্দ্রীয় কবর স্থানে দাফন করা হয় তাকে।

আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার আর কোনো স্বপ্ন রইলো না। পিতা হিসেবে খুব অসহায় বোধ করছি। কেনো এমন হলো? আমার ছেলে তো কোনো দোষ করেনি!’

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ভাগিরভিটা গ্রামের আমির হোসেনের দুই ছেলের মধ্যে নুর আলম বড়। বাবা আমির হোসেন ভ্যান চালক। মা নুর বানু গার্মেন্টস কর্মী। নুর আলম ছিলেন রাজমিস্ত্রী। সবার ছোট নুর জামাল (১৪) অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করে। এক বছর আগে বিয়ে করেন নুর আলম। স্ত্রী খাদিজা অন্তঃসত্ত্বা। পরিবারের সবাই মিলে ভাড়া থাকতেন গাজিপুর চৌরাস্তার তেলিপাড়া এলাকায়।

প্রত্যক্ষদর্শী আশিক ও আব্দুল্লাহর দেওয়া তথ্যমতে নুর আলমের বাবা আমির হোসেন জানান, গত ২০ জুলাই সকাল ৯টার দিকে ঠিকাদারের সাইডের কাজ থেকে বাসায় ফিরছিল নুর আলম। পথে চৌরাস্তা এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে সে। এক পর্যায়ে তার ডান চোখে গুলি লাগলে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়ে সে। ঘটনাস্থলের লোকজন তাকে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ডা. আবিদ বিল্লাহ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তারা লাশ নিয়ে যায় জয়দেবপুর সরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে রাত ১০টায় লাশ হস্তান্তর করেন। পরদিন ২১ জুলাই গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়।

নুর আলমের মা নুর বানু বলেন, ‘আমার ছেলে রাজনীতি করে না। কাজ করে খায়। আমরা গরিব মানুষ। আমার পোলার কী অপরাধ ছিল? তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। এর কোনো বিচার নাই! আমি বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই। আমার বউমা ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার ছেলেটা সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারল না। কী হবে ওর স্ত্রী-সন্তানের?’

ঢাকার আফতাবনগরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিজিবির গুলিতে মারা যায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কেদার ইউনিয়নের কচাকাটা বাজার এলাকার সাইদুর রহমানের ছেলে গোলাম রব্বানী (২০)।

নিহত গোলাম রব্বানীর সহকর্মী একই এলাকার বাসিন্দা রাসেল ইসলাম (২২) জানান, তারা রামপুরা আফতাবনগরে থাকতেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় আফতাবনগরে ই-ব্লকে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন তারা। এ সময় রাতের খাবার জন্য পাশের খাবারের দোকানে যাওয়ার পথে আকষ্মিক বিজিবি’র ছোড়া ছররা গুলিতে আহত হন গোলাম রব্বানী। পেটের নিচে গুলি লাগে তার। তাকে দ্রুত পাশের একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দেয়। পরে সেখান থেকে শ্যামলির একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে মরদেহ কুড়িগ্রাম নিয়ে আসে রাসেল ইসলাম।

গত ২০ জুলাই শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে মরদেহ নাগেশ্বরীতে নেওয়া হয়। পরদিন রোববার সকাল ৯টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

নিহত রব্বানীর বাবা সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে নিরাপরাধ ছিল। রাজনীতির সাথে-পাছে ছিল না। ওর রোজগারে আমাদের সংসার চলতো। এখন আমাদের সংসার কীভাবে চলবে? এ ঘটনার ন্যায় বিচার চাই আমি।’

Join Manab Kallyan