বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ৭ এপ্রিল। ১৯৪৮ সালের এই দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধান প্রথমবারের মতো কার্যকর করা হয়। প্রতি বছর এই দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছর আমরা “আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার” প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালন করছি। সবার মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও তথ্য পাওয়ার অধিকার, সর্বত্র সবার অধিকারকে গুরুত্ব দেয়ার প্রত্যয়ে এবারের প্রতিপাদ্য বেছে নেয়া হয়েছে। আমাদের নিরাপদ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বাতাস আর ভালো পুষ্টির অধিকার সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে এই প্রতিপাদ্য। এই প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে মানসম্পন্ন আবাসন, শালীন কাজকর্ম ও পরিবেশগত অবস্থা আর বৈষম্য থেকে স্বাধীনতা সবার অধিকার। এই অধিকার সবার থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সব ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ মানদণ্ডে অর্জনে কাজ করতে হবে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজের অন্যতম বিষয়। সব ব্যক্তির জাতি বা ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, তাদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা যেন কোনো বাধা হিসেবে না দাড়ায় তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের জন্য আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে মানুষেরা “স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে আর তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে”। আমি এমন একটি অঞ্চল দেখতে চাই যেখানে “জন্মের আগে থেকে স্বাস্থ্যের অধিকার প্রত্যেক মানুষের জন্য থাকবে। সবচেয়ে দুর্বল থেকে শুরু করে সব সম্প্রদায়কে সেবার আওতায় যুক্ত করতে হবে।” প্রশ্ন করতে পারেন, স্বাস্থ্যের অধিকার কীভাবে অর্জন করা যায়?
উচ্চ-মানের স্বাস্থ্য পরিষেবায় সর্বজনীন সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। আর স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় যেমন শিক্ষা, নিরাপদ খাদ্য ও পানি, পর্যাপ্ত আবাসন, ভাল পরিবেশসহ আরো অনেক কিছুর সমাধান করার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। সংক্ষেপে বলা যায় স্বাস্থ্য অধিকারের প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো একই সঙ্গে নির্ধারিত মানে সবার জন্য উপলব্ধ করতে হবে। সবার গ্রহণের সুযোগ থাকবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে আমরা গর্বের সঙ্গে বলছি। আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল স্বাস্থ্যের অধিকারের বিষয়ে অনেক অর্জন করেছে। অনেক কিছু উদযাপন করার মতো রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে আমাদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সূচকে উন্নতি করে চলেছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ বা ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ সার্ভিস সূচক ২০১০ সালের ৪৭টি দেশ থেকে ২০২১ সালে ৬২টি দেশে উন্নীত হয়েছে। গড়ে চিকিৎসকদের সেবা ২০১৫ সালের চেয়ে ৩০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বর্তমানে প্রতি ১০ হাজার জনকে গড়ে ২৮ জনের বেশি সেবা দিচ্ছেন। সংখ্যার এই বিকাশ পুরো অঞ্চল জুড়ে চলমান স্বাস্থ্য পেশাদারদের শিক্ষামূলক রূপান্তরধর্মী উদ্যোগের কারণেই হচ্ছে। ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমাদের অঞ্চলে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে সাড়ে ৬৮ শতাংশ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার প্রতি এখন ২৯, যা আগে ছিলো ৮৪। নবজাতকের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে এখন ১৭, যা আগে ছিলো ৪১। ডিপথেরিয়া, টিটেনাস টক্সয়েড অ্যান্ড পারটুসিস (ডিটিপি৩), মিজেলস কনটেইনিং ভ্যাকসিন সেকেন্ড ডোজ (এমসিভি২) ও নিউমোকোকাল কনজুগেট ভ্যাকসিন (পিসিভি৩) টিকার আঞ্চলিক টিকাদান কভারেজ ২০২১ থেকে ২০২২ সালে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের বৈশ্বিক লক্ষ্যে অর্জনের জন্য বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্রই ডিটিপি৩ ও এমসিভি২ টিকার ৯০ শতাংশের বেশি কভারেজ পূরণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
২০১৫ সাল ও ২০২১ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে নতুন এইচআইভি সংক্রমণ ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর ম্যালেরিয়ার সংক্রমণের হার ৬২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০১৫ সাল ও ২০২২ সালের মধ্যে গড় আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য প্রবিধান বা ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশনস (আইএইচআর) কোর ক্যাপাসিটি ইনডেক্সের মান ৬৪ থেকে ৬৮-তে উন্নীত হয়েছে। তবুও চ্যালেঞ্জ রয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই অঞ্চলের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ এখনো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবার আওতার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। কোভিড ১৯ মহামারী কিছু সদস্য রাষ্ট্রে স্থবিরতা এনেছে, অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্যে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। এই অঞ্চলে বর্তমান সরকারসমূহের স্বাস্থ্যে ব্যয় অগ্রহণযোগ্যভাবে কম। যার কারণে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন পরিবারের অনুপাত বিভিন্ন দেশে বাড়ছে। অনেক পরিবার আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়ছে।
যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় আমরা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ দেখছি। যদিও ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের চারটি প্রধান রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা ২০০০ সালের চেয়ে ১৩ শতাংশ কমেছে। এই রোগসমূহ হচ্ছে: কার্ডিওভাসকুলার রোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ। যদিও এই মৃত্যুর হার এখনো অগ্রহণযোগ্যভাবে ২১.৬ শতাংশ উচ্চ রয়ে গেছে। উদ্বেগজনকভাবে যত্ন বা সেবার অভাবের চেয়ে নিম্নমানের যত্নের কারণে বেশি মৃত্যু হয়। দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিরা প্রায়শই খারাপ যত্ন পাচ্ছেন।
এখনো অনেকেই বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ে স্টিগমার শিকার হচ্ছেন। এইচআইভি/এইডস, অক্ষমতা বা মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থার জন্য স্টিগমা আছে। এছাড়াও অনেক ব্যক্তি লিঙ্গ, শ্রেণী, জাতি, ধর্ম, যৌন পরিচয় বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। লিঙ্গ বৈষম্য অসংক্রামক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সার ন্যায়সঙ্গত সুযোগ নিতে বাধা দিচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়া নারীরা পুরুষের চেয়ে কম চিকিত্সা পান। এই বৈষম্য উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। নারী ও কন্যা শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। যা তাদের মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
এই পটভূমিতে আমরা সব সরকারকে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানাই। বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে মনোনিবেশ করতে আহ্বান করছি। তামাক নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নত পুষ্টি সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার ভালো আইন ও নীতি অপরিহার্য। স্বাস্থ্য সেবা সব ব্যক্তির জন্য আরো বৈষম্যহীন ও অ্যাক্সেসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য এবং উন্নত মানের করতে হবে।
এসব সমস্যাসহ অন্যান্য বিষয় সমাধানের জন্য আমি আমার মেয়াদে গুরুত্ব দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে পাঁচটি অগ্রাধিকার ক্ষেত্র নিয়ে রূপরেখা দিয়েছি। যার মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু (গর্ভবতী নারীসহ), ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন।
এইসব ক্ষেত্রে আমরা যে অর্জন করবো আমাদের জনগোষ্ঠী ও বিভিন্ন দেশে অনুভূত হবে। দীর্ঘস্থায়ীভাবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুযোগ তৈরি করবে। স্বাস্থ্যের অধিকারকে সম্মান করা, রক্ষা করা আর তা পূরণ করে প্রগতিশীলভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিভিন্ন সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো সংস্থার ওপর নির্ভর করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আসুন এমন একটি ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনরায় ব্যক্তি করি, যেখানে স্বাস্থ্য একটি বিশেষ সুবিধা নয় বরং একটি প্রতিশ্রুতি। এ প্রতিশ্রুতি সব জায়গায় সবার মর্যাদা ও মঙ্গলের জন্য। চলুন সবাই মিলে মনে রাখি “আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার”।
সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক। তার লেখা এই নিবন্ধটি বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রেক্ষিতে ব্যাংকক পোষ্টে ৮ এপ্রিল প্রকাশিত হয়।
লেখক: আশা জাহিদ, সূত্র: ব্যাংকক পোষ্ট